ইমরান হোসেন ইমন, অনুসন্ধান বার্তা :
বহু বছর আগে স্বামী মারা গেছে সামিতন বেওয়ার (৬৩)। সন্তান বলতে রয়েছে এক কণ্যা। তাকেও বিয়ে দিয়েছেন। স্বামীর রেখে যাওয়া ভিটে মাটিতে ছাপড়া ঘরে একাকী বসবাস করেন বিধবা সামিতন বেওয়া। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও ক্ষুধার জ্বালায় মাটি কাটার কাজ করে যে টাকা আয় করেন তা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।
তাই চেয়ারম্যানের কাছে ধর্ণা দিয়েছিলেন বয়স্ক অথবা বিধবা ভাতার সরকারি কার্ডের জন্য। এর বিনিময়ে চেয়ারম্যানকে দিতে হয়েছে ৫ হাজার টাকা। তাও আবার ৪ বছর আগের কথা। দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে গেলেও সামিতন বেওয়ার ভাগ্যে জোটেনি সরকারি ভাতার কোন কার্ড !
দীর্ঘ দিনেও টাকা ও কার্ড কোনটাই না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে বগুড়ার ধুনট উপজেলার গোসাইবাড়ী ইউনিয়নের পারনাটাবাড়ী গ্রামের মৃত আজাহার প্রামাণিকের স্ত্রী অসহায় সামিতন বেওয়া।
শুধু সামিতন বেওয়া নয় তার মতো আরো প্রায় শতাধিক অসহায় মানুষকে সরকারি বিভিন্ন সহয়তা প্রদান ও আশ্বাস দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বগুড়ার ধুনট উপজেলার গোসাইবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মঈনুল হাসান মুকুল। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এসব অসহায় ভুক্তভোগিরা কোন কার্ড বা টাকা ফেরত না পাওয়ায় এখন তারা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন।
আরেক ভুক্তভোগি পারনাটাবাড়ী গ্রামের মৃত খাদেম আলীর স্ত্রী জয়গন বেওয়া। তিনি ঝিয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারও স্বামী মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। তাই তাকেও একটি বিধবা অথবা বয়স্ক ভাতা কার্ড দেওয়ার কথা বলে গত ১ বছর আগে ৪ হাজার নিয়েছেন গোসাইবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান মঈনুল হাসান মুকুল। কিন্তু তাকেও কোন কার্ড বা টাকা ফেরত দেয়নি ওই ইউপি চেয়ারম্যান।
একই ভাবে পারনাটাবাড়ী গ্রামের মৃত বাইচ আলী প্রামাণিকের স্ত্রী প্রতিবন্ধী ফাতেমার কাছ থেকেও ৬ হাজার টাকা আদায় করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান মঈনুল হাসান মুকুল। গত ৪ বছর অতিবাহিত হলেও তারও ভাগ্যে জোটেনি সরকারি ভাতার কার্ড।
প্রতিবন্ধী বিধবা ফাতেমা কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ছেলে-মেয়েরা তেমন কোন ভরন পোষন করেন না। একারনে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি। গত ৪ বছর আগে আমাকে একটি কার্ড করে দেওয়ার কথা বলেন চেয়ারম্যান মঈনুল হাসান মুকুল ও দুলাল আমার কাছ থেকে ৬ হাজার নিয়েছে। কিন্তু আজও পর্যন্ত কোন কার্ড করে দেননি। তার কাছে টাকা ফেরত চাইতে গেলে সে আরও ২ হাজার টাকা দাবি করে।
ফাতেমা বলেন, আমরা গরীব মানুষ। কনো মতে খেয়ে না খেয়ে থাকি। অত টাকা কন থেকে দিমু। অনেক দিন হলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়েও চেয়ারম্যান টাকাও ফেরত দেয় না কার্ডও করে দেয় নাই। শুনেছি আমার চেয়েও আরো বেশি টাকা নিয়ে চেয়ারম্যান অনেককে কার্ড করে দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালে ধুনট উপজেলার গোসাইবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচত হন ধুনট উপজেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য মঈদুল হাসান মুকুল। এরআগেও তিনি ১৯৯৪, ২০০২, ২০০৬ সালে এই পরিষদে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
কিন্তু অভিযোগ রয়েছে বিএনপি নেতা মঈদুল হাসান মুকুল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ না করেই অর্থ আত্মসাত, জমি আছে ঘর নেই প্রকল্পে অর্থ আত্মসাত, ১০ টাকা কেজি দরের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির কার্ড বিতরণ না করেই চাল আত্মসাত, অর্থের বিনিময়ে বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড বিতরণ এবং কার্ড দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
তবে এসব বিষয়ে মোবাইলফোনে মঈনুল হাসান মুকুল তার বিরুদ্ধে কিছুটা অভিযোগ অস্বীকার করলেও জয়গন বেওয়া নামের এক মহিলার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।
তিনি দাবি করে বলেন, জয়গন বেওয়াকে টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ‘জমি আছে ঘর নেই’ প্রকল্পে টাকা আত্বসাতের বিষয়টি মোবাইলফোনে অকপটেই স্বীকার করে নেন ইউপি চেয়ারম্যান মঈনুল হাসান মুকুল।
তিনি বলেন, কয়েকটি ঘরের উপর টাকা নিয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ নেতাদের সমঝোতায় জমি বিক্রি করে সেই টাকা আবার ফেরতও দিয়েছি। তারপরও কতিপয় ইউপি সদস্যরা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলে তিনি দাবি করেন।
এবিষয়ে ধুনট উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ্ আল কাফী বলেন, গত এক মাস আগে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের কার্ড বিতরণ ও টাকা প্রদান করা হয়েছে। তবে কার্ড দেওয়ার নামে কোন চেয়ারম্যান বা মেম্বার টাকা আদায় করেছেন কিনা তা জানা নেই। তারপরও বিষয়টি তদন্ত করে উর্দ্ধতন কৃর্তপক্ষকে অবহিত করা হবে।
ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার মহন্ত বলেন, কয়েকদিন আগে ইউপি চেয়ারম্যান মঈনুল হাসান মুকুলের বিরুদ্ধে কিছু মহিলা কার্ড দেওয়ার নামে অর্থ আত্মসাতের লিখিত অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।